কোন বাণিজ্যে নিবাস তোমার, কহো আমায় ধনী
তাহা হলে সেই বাণিজ্যের করব মহাজনী
আজ থেকে শতবর্ষ আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের
প্রতি তার অভিলাস বা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
একটি পরিকল্পিত যুগসই ব্যবসায়ের আইডিয়া আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তব
করে তুলতে পারে। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ভালোবাসা এবং দেশের প্রতি
দায়বদ্ধতা আমাদের যেকোনো ব্যবসায় গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ
পুঁজি হিসেবে কাজ করে।
প্রতিদিন আমরা যেসব পণ্য ও সেবা ব্যবহার করি, কখনো কি ভেবে দেখেছ এগুলো কারা উৎপাদন করে? কেনই বা উৎপাদন করে, কীভাবে উৎপাদন করে, কে সরবরাহ করে কিংবা কোথায় পাওয়া যায়, তা জানতে ইচ্ছা করে তোমাদের? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখবে, আমাদের যা কিছুই প্রয়োজন হোক না কেন, কেউ না কেউ তা সরবরাহ করছে। অর্থাৎ তোমার বা তোমার পরিবারে কিছু পণ্য বা সেবার চাহিদা আছে এবং সেগুলো কিনে তুমি তোমার চাহিদা মিটাতে পারো। এখন তোমাদের আশেপাশে যারা এসব পণ্য বা সেবা বিক্রি করছেন বা সরবরাহ করছেন, বাজারে সেই পণ্য বা সেবার ঘাটতি আছে। তারা যদি এই পণ্য বিক্রি করেন বা কোনো সেবা প্রদান করেন তাহলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা মিটবে এবং তারও ব্যবসা হবে। তাই দেখতেই পাচ্ছ, একটি ব্যবসায় আইডিয়া তখনই আসে, যখন কোনো একটি পণ্য ও সেবা উৎপাদন বা উদ্ভাবন বা সরবরাহের মাধ্যমে কোনো একটি সমস্যার সমাধান করা যায় বা জনসাধারণের কোনো চাহিদা মিটানো যায়।
স্থানীয় সম্পদের পরিচয়
আমরা যে এলাকায় থাকি সেখানকার স্থানীয় সম্পদ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
চিত্র ৪.১: বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সম্পদ (কক্সবাজারের সোনাদিয়ার শুটকি, খুলনার সুন্দরবনের গোলপাতা)
আমরা যে এলাকায় থাকি সেখানকার মাটি, পানি, আলো-বাতাস, ফুল-ফসল, গাছপালা, পুকুর-নদী-সমুদ্র, বন-জঙ্গল নিয়ে যে পরিবেশ, তার সব কিছুই কিন্তু এক একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন: তেল, গ্যাস, কয়লা, পাথর, বালির মতো খনিজ সম্পদ যেমন আছে, আবার স্থানীয় কৃষি জমি, ফসল, জলাধার, বন, বনের কাঠ, বাঁশ, বেত এগুলোও আছে। এসব জিনিস সব জায়গায় সমানভাবে পাওয়া যায় না। যেমন- সিলেটের জাফলং এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে পাথর পাওয়া যায় যা অন্য এলাকায় পাওয়া যায় না, কক্সবাজারের টেকনাফে সমুদ্রের পানি আটকে রেখে লবণ চাষ করা হয়, যা দেশের অন্যান্য জায়াগায় সম্ভব না, সুন্দরবন এলাকায় গোলপাতা, মধু ও কাঠ পাওয়া যায়, পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়, রাজশাহী অঞ্চলে ভালো আম পাওয়া যায়, যশোর অঞ্চলে শীতলপাটির উপকরণ পাওয়া যায় এবং ফুলের চাষ হয়। এভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কিছু না কিছু সম্পদ রয়েছে যা স্থানীয় সম্পদ নামে পরিচিত। কেউ এসব স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করছেন, কেউ এগুলো উৎপাদন করছেন, কেউ সরবরাহ করছেন। অর্থাৎ যার যার এলাকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার সম্পদকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। এসব স্থানীয় সম্পদকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়।
স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার
আমাদের দৃষ্টিতে কোনো জিনিসকে সম্পদ মনে নাও হতে পারে। তবে মানুষ তার সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সাধারণ কাঁচামাল দিয়েও অসাধারণ বস্তু তৈরি করতে পারেন। যেমন ধরো, কোনো এলাকায় খুব ভালো এঁটেল মাটি পাওয়া যায়, যা ওই এলাকার একটি স্থানীয় সম্পদ। এই এঁটেল মাটি দিয়ে উক্ত এলাকার কিছু মানুষ মাটির হাঁড়িপাতিল, থালা-বাটি, খেলনা, ইট, টালি ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি করেন এবং এসব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে। একইভাবে, যেসব এলাকায় বাঁশ, বেত বা পাট উৎপাদন হয়, সেইসব এলাকার জন্য এগুলোও স্থানীয় সম্পদ, কারণ এগুলো বিক্রি করে অর্থ আয় করা যায়। আবার এগুলো দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা যায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে। কোনো কোনো শ্রমিক কাপড় বুনতে খুব দক্ষ যেমন: শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরি করেন, এক্ষেত্রে কাপড়ের কাঁচামাল এবং শ্রমিকের দক্ষতা দুটোই কিন্তু স্থানীয় সম্পদ। স্থানীয় সম্পদের বৈচিত্র্যের ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে ওঠে। তবে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎসের পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কাঁচামালের প্রয়োজন হতে পারে।
তোমাদের স্থানীয় বাজার বা হাটে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখবে যে, তারা স্থানীয় লোকজনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা পূরণ করে। যেমন: কাঁচাবাজার, তৈজসপত্র, মুদি ও কনফেকশনারি পণ্য, ওষুধ, হার্ডওয়্যার পণ্য এবং বিভিন্ন সেবা; যেমন: কাপড় সেলাইয়ে জন্য দর্জি, চুল কাটার জন্য সেলুন, যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন যানবাহনের সেবা ইত্যাদি। আবার অনেক পণ্য ও সেবা আছে যা হয়তো স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায় না, দূরবর্তী বড় বাজারে বা শহরে গিয়ে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। যেমন: পোশাক, গহনা, গৃহস্থালির ইলেকট্রিক পণ্য, ঘরবাড়ি নির্মাণসামগ্রী ইত্যাদি। পণ্য ছাড়াও বিভিন্ন সেবা নিতেও আমাদের অনেক সময় দূরবর্তী স্থানে যেতে হয়; যেমন: ব্যাংক, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকে ডিজিটাল মাধ্যম বা অনলাইনে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ব্যবসা করছেন, স্থানীয় পণ্য ও সেবা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন। ফলে ঘরে বসেও এখন অনেক ব্যবসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
চলো এবার তাহলে খুঁজে বের করি, আমাদের নিজেদের এলাকার মানুষজন কী ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
দলগত কাজ
তোমাদের অভিজ্ঞতায় নিজেদের এলাকায় যেসব ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা আছে, তার একটি তালিকা তৈরি করো। এসব ব্যবসার ধরনগুলো কী কী। এখানে কি কিছু উৎপাদন করছে? নাকি পণ্য বিক্রি করছে? নাকি কোনো সেবা দিচ্ছে? ব্যবসাটি খুচরা ব্যবসা নাকি পাইকারী ব্যবসা? |
---|
ক্রম | ব্যবসার নাম/প্রতিষ্ঠানের নাম | ব্যবসার ধরন |
---|---|---|
১. | মুদি দোকান | বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন: চাল, ডাল, লবন, তেল, মসলা ইত্যাদি বিক্রয় করা হয়। খুচরা বিক্রেতা |
২. | ||
৩. | ||
৪. | ||
৫. |
স্থানীয় বাজার পর্যবেক্ষণ
আমাদের দেশে তরুণরা আজকাল স্থানীয়ভাবে ব্যবসার নতুন আইডিয়া খুঁজে নিয়ে চমৎকার কাজ করছে। তরুণদের এমনই একটি দল স্থানীয় দর্জির দোকান থেকে কুট কাপড় সংগ্রহ করে ব্যাগ বানিয়ে নতুন একটি ব্যবসা শুরু করেন। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ আজ ব্যাপক প্রচার ও প্রসার পেয়ে এখন বিদেশে রপ্তানিতেও জায়গা করে নিয়েছে।
একই রকম আরেকটি গল্প শুনি। ঘটনার শুরুটা ঢাকা শহরের কোনো এক বাড়িতে। এই বাড়িতে বড় রুই মাছ উচ্চ তাপে সিদ্ধ করে কাটা ছাড়িয়ে নিয়ে বল তৈরি করা হতো বিকালের নাস্তার জন্য। মাছের এই বল খেয়ে বাড়িতে আসা এক অতিথি নতুন আইডিয়া পেয়ে যায়। সে তা কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেন বিশেষ পদ্ধতির ফিস প্রসেসিং এর কারখানা। তার কারখানা থেকে প্রসেস করা ফিস বল চলে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। সেই উদ্যোক্তা আজ অনেক সম্পদের মালিক: পাশাপাশি রয়েছে ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিতি।
দুটো ঘটনাতে ব্যবসার শুরুটা হয়েছে একেবারে স্থানীয়ভাবেই। এ কারণে নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসা সম্পর্কে সত্যিকারের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এলাকার বাজারে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, কীভাবে তারা এই ব্যবসা শুরু করেছেন, কী কী পণ্য বা সেবা তারা উৎপাদন বা সরবরাহ করেন।
যেকোনো সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য কিছু প্রস্তুতির দরকার হয়। স্থানীয় বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমতো দরকার একটি সাক্ষাৎকারপত্র, যেটি সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে আমাদের খুব কাজে আসবে। দ্বিতীয়ত, সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বিদ্যালয় থেকে একটি অনুমতিপত্র। দুটি কাজ আমরা দলে ভাগ হয়ে তৈরি করব এবং প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তা নেব। পর্যবেক্ষণ করার জন্য সাক্ষাৎকারপত্রে ব্যবসার বিভিন্ন বিষয় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। যেমন: পণ্য বা সেবার তালিকা, ক্রেতা বা টার্গেট কাস্টমার, বিক্রীত পণ্যের উৎস অর্থাৎ কোথা থেকে তারা এসব পণ্য সংগ্রহ করেন, ব্যবসা পরিচালনার সময় অর্থাৎ ব্যবসাটি কখন খোলা থাকে, ব্যবসাটি কি দৈনিক? সারা বছর চলে নাকি মৌসুমি? ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় উপস্থিত কোনো প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক মনে হলে তা সাক্ষাৎকারপত্রে যুক্ত করা যেতে পারে।
প্রথমে আমরা একটি সাক্ষাৎকারপত্র তৈরি করব। এরপর সময় ও সুযোগ অনুযায়ী স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ এলাকার বাজার পর্যবেক্ষন করব (পরবর্তী ক্লাসের আগে দলগতভাবে বা পরিবারের সহায়তায়)।
সাক্ষাৎকারণত্রের নমুনা:
স্থানীয় বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য সাক্ষাৎকারপত্র
বিষয়: জীবন ও জীবিকা,
শ্রেণি: অষ্টম
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম:--------------
উত্তরদাতার তথ্য | |
---|---|
ব্যবসায়ীর নাম | |
ব্যবসার ধরন | |
ঠিকানা |
নিজের অনুভূতি সাক্ষাৎকারের পর এই অভিজ্ঞতা তোমার জীবনে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিজ পরিবারের সদস্য আত্মীয়/বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজের অনুভূতি লিখবে।)
|
অনুমতিপত্রের নমুনা:
সাক্ষাৎকারের অনুমতিপত্র
কার্যক্রমের নাম | স্থানীয় বাজার পর্যবেক্ষণ |
---|---|
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম/দলের সদস্যদের নাম | |
বিদ্যালয়ের নাম |
অষ্টম শ্রেণির 'জীবন ও জীবিকা' বিষয়ে শিক্ষার্থীদের স্থানীয় সম্পদ, স্থানীয় ব্যবসা ও বাজার পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা বাজার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উক্ত কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে। এ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
বিষয় শিক্ষক/প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বাক্ষর
প্রতিষ্ঠানের নাম:---------
ফোন নম্বর-------------
স্থানীয় বাজার পর্যালোচনা করি
আমরা স্থানীয় বাজারে নিজ দায়িত্বে বা দলগতভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। যেসব পণ্য বা সেবা বাজারে পাওয়া যায়, তার একটি সম্মিলিত তালিকা তৈরি করে বাজারম্যাপ অঙ্কন করব। বিদ্যালয়কে মাঝখানে রেখে আশেপাশের কোন এলাকায় কী কী পণ্য পাওয়া যায়, কোনো স্থানীয় পণ্য রয়েছে কি না, কয়টি বাজার আছে এবং সেসব বাজারে কী কী পণ্য পাওয়া যায়, ইত্যাদি বিষয় উক্ত ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করব। প্রথমে আমরা শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে সবার তথ্য নিয়ে প্রাথমিক ম্যাপটি আঁকব, এরপর আমরা প্রতিটি দল নিজেদের খাতায় অথবা পোস্টারে সেই ম্যাপ পুনরায় আঁকব।
চিত্র ৪.২: স্থানীয় ন্যাপ
আমাদের তৈরিকৃত ম্যাপে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। নিজেদের এলাকায় স্থানীয় সম্পদ কী আছে, প্রয়োজন অনুযায়ী সকল পণ্যের বাজার রয়েছে কি না, আবাসন ও বাজার স্থানীয় লোকজনের সীমানার মধ্যে রয়েছে কি না, জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্যের বাজার ও সরবরাহ পর্যাপ্ত কি না, চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ কোনো পণ্যের ঘাটতি রয়েছে কি না, ইত্যাদি বিষয় সহজেই পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে। দলগতভাবে আলোচনার মাধ্যমে আমরা উল্লিখিত দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করব এবং তথ্যগুলো নিজেদের খাতায় লিপিবদ্ধ করব।
সাহস নিয়ে উদ্যোক্তা হবো, থাকবো সবাই সুখে
কর্মহীনে কর্ম দিবো, বেকারত্ব দিবো রুখে।
আমাদের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবার প্রয়োজন হয়। আর এসব প্রয়োজন পূরণ করতে ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন ব্যবসায়িক আইডিয়া নিয়ে কাজ করে। একটি পরিবারে বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিন্ন প্রয়োজন থাকে। যেমন: শিশুদের জন্য হয়তো শিশু খাদ্য, কাপড়, খেলনা; কিশোরদের জন্য খেলার সামগ্রী, শিক্ষার সামগ্রী; গৃহস্থালির জন্য চাল, ডাল, আটা ইত্যাদি পণ্য; বয়স্কদের জন্য হয়তো বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। আবার নিজেদের প্রয়োজন ছাড়াও গৃহপালিত পশু বা পোষা প্রাণীর জন্য বিভিন্ন পণ্য, শখ পূরণে বাগান করতে বা খেলাধুলার জন্য অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন হয়। আবার বিভিন্ন পণ্য বা সেবা উৎপাদনের জন্যও বিভিন্ন পণ্য বা সেবার প্রয়োজন হয়। যেমন: কৃষি পণ্য উৎপাদনে সার, কীটনাশক, বীজ, কৃষি শ্রমিক ইত্যাদির প্রয়োজন হয়; নির্মাণ ব্যবসায় ইট, সিমেন্ট, পাথর, বালু, নির্মাণ শ্রমিক ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের আশেপাশে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগ দেখতে পাই।
প্রতিটি ব্যবসার আইডিয়া একেকটা চাহিদা পূরণ করাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়। কোনো ব্যবসার যদি সুবিধাভোগী বা ক্রেতা না থাকে, তাহলে সেই ব্যবসা স্থায়ী বা টেকসই হয় না। অনেকেই ব্যবসা শুরু করে তাদের নিজেদের এলাকার স্থানীয় পণ্য বা হাতের কাছে পাওয়া যায়, এমন সব সামগ্রী দিয়ে। দেখা যায়, সেসব পণ্যের চাহিদা বাড়লে ধীরে ধীরে উক্ত ব্যবসা স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। চলো এমন কিছু সফল ব্যবসা সম্পর্কে জানি-
ফেস ১: বাদল মান্ডি পঞ্চগড় জেলার একটি স্কুলের শিক্ষার্থী এবং সে ছবি তুলতে খুব ভালোবাসে। গত বছর সে স্কুল থেকে স্কাউট জাম্বুরিতে গিয়েছিল। সেখানে তার অনেক নতুন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে স্কাউটভিত্তিক একটি অনলাইন গ্রুপের সঙ্গে সে যুক্ত হয়। পঞ্চগড়ের সমতল ভূমির চা বাগান তার খুব পছন্দ। সে এখানকার চা-বাগানের ছবি তুলে, কীভাবে চা-পাতা থেকে চা তৈরি হয় সেসব ছবি তুলে এবং স্থানীয় বাজারে যে খুব ভালো মানের চা পাওয়া যায়, সেই তথ্য সহকারে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে। সে পোস্টগুলো স্কাউট গ্রুপেও শেয়ার করে এবং সারা দেশের অনেক বন্ধু এই ছবি দেখে খুব পছন্দ করে এবং তার মাধ্যমে পঞ্চগড়ের চা কেনার আগ্রহ জানায়। বাদল প্রথমে বুঝতে পারছিল না কীভাবে তার বন্ধুদের ইচ্ছা পূরণ করা যায়। তাই সে তার বাবার সঙ্গে আলোচনা করে এবং স্থানীয় চা বাজার থেকে কয়েক কেজি চা ক্রয় করে আলাদা আলাদা প্যাকেটে করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কয়েকজন বন্ধুকে পাঠিয়ে দেয়।
বন্ধুরা তার পাঠানো চা খুব পছন্দ করে, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে চায়ের মূল্য পরিশোধ করে। পাশাপাশি অনলাইন পোস্টেও তার পাঠানো চায়ের খুব প্রশংসা করে। সেই সূত্র ধরে বাদলের কাছে আরও অনেকে অর্ডার করতে থাকে। বাদল পড়াশোনার পাশাপাশি তার শখকে একটি ছোট্ট ব্যবসায়ে রূপান্তর করল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আলাদা পেজ খুলে নাম দিলো 'দ্য গ্রেট টি ফ্লেভার ফ্রম পঞ্চগড়'। সেখানে বিভিন্ন ধরনের চায়ের ছবি, চায়ের মূল্য ও যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিল। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেজ থেকে দেশ-বিদেশের অর্ডার নিয়ে পঞ্চগড়ের সবচেয়ে ভালো মানের চা সংগ্রহ করে ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়ে দেয়।
চিত্র ৪.৩। চা সংগ্রহের বাগান
সর্বোচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন চা সরবরাহের ব্যাপারে সে সব সময় সতর্ক থাকে এবং ন্যায়সংগত যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করে। ফলে গ্রাহকও সন্তুষ্ট হয়ে বারবার পেজে নক করে। সততা তার ক্ষুদে ব্যবসায়কে কিছুদিনের মধ্যেই বেশ বিস্তৃত করে তোলে। ব্যবসার কাজে তাকে সহযোগিতা করে তার পরিবারের সবাই। পণ্য সরবরাহ ও কুরিয়ার করার জন্য একজন দক্ষ কর্মীও নিয়োগ দিয়েছে তারা।
বাদল মাণ্ডির ব্যবসার বিশেষত্ব
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
কেস ২: সুনামগঞ্জের তাহিরপুর একটি হাওর অধ্যুষিত এলাকা। শুকনা মৌসুমে হাওরে ধান চাষ হয় আর বর্ষার মৌসুমে পুরো জনপদ পানির নিচে তলিয়ে যায়। অনেক মানুষেরই তখন কাজ করার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। কেউ কেউ হয়তো কাজের খোঁজে শহরে চলে যান। সাজু আর সজীব দুই বন্ধু তাহিরপুরের একটি স্কুলের শিক্ষার্থী। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা লক্ষ করে যে, বর্ষায় বিভিন্ন এলাকার মানুষ হাওরে বেড়াতে আসে। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ধীরে ধীরে একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। দুই বন্ধু তখন নতুন আসা পর্যটকদের সঙ্গে ঘুরে ট্যুর গাইডের কাজ শুরু করে। হাওরে ঘুরতে গিয়ে কীভাবে নৌকা ভাড়া করবে, কোন কোন স্পটে যাবে, কোথায় আকর্ষণীয় ছবি তুলবে, কী কী খাবার এখানে বিখ্যাত, বিশেষ করে এলাকার
বিখ্যাত 'হাঁসের মাংস আর চালের রুটি' কোন হোটেলে ভালো পাওয়া যাবে- এসব বিষয়ে তারা পর্যটিকদের
চিত্র ৪.৪: টাঙ্গুয়ার হাওর
সহায়তা করে। কিছুদিনের মধ্যেই তারা পর্যটনের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরও কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে 'টাঙ্গুয়া ট্যুর এক্সপার্ট' নামে একটি গ্রুপ তৈরি করল এবং আগত পর্যটকদের আরও বড় পরিসরে সেবা দেওয়া শুরু করল। এখন বর্ষার মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে স্কুল বন্ধের দিন তারা পর্যটকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এলাকায় তারা খুব জনপ্রিয় ট্যুর গাইড হিসেবে পরিচিত। সাজু ইতিমধ্যে লক্ষ করেছে, পর্যটকদের অনেকেই এখানে বেড়াতে এসে বিভিন্ন স্থানীয় পণ্যের খোঁজ করেন। তাই তারা ট্যুর গাইড সেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাওরে উৎপাদিত লাল চাল, স্থানীয় হাঁসের ডিম সংগ্রহ করে পর্যটকদের কাছে যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি করা শুরু করল। কয়েক বছরেই তাদের এই ব্যবসা দারুন সাফল্য পায়। যেসব পর্যটক এখানে একবার আসেন, তারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য নিজেদের সংগ্রহে রাখেন। দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই এদের কাছ থেকে শুকনা মৌসুমে এসব পণ্য অর্ডার করেন। ফলে সারা বছরই এখন তাদের ব্যবসা চলমান থাকে।
সাজুদের ব্যবসায় সম্প্রসারণের কারণ
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
ফেস ৩: আসমার গ্রানের মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। আশেপাশে কোনো শিল্পকারখানা নেই, নেই বড় কোনো কৃষি জমি বা স্থানীয় বড় কোনো ব্যবসা। গ্রামের অনেকেই কাজের খোঁজে শহরে বা অন্যান্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। তার বাবা গ্রামে একটা ছোট্ট মুদিদোকান চালান। পড়াশোনা করে গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা থেকেই আসমা বিভিন্ন উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে ভাবত। একবার সে বাবার সঙ্গে শহরে ঘুরতে যায়।
চিত্র ৪.৫: কচুর লতির বাগান
সেখানে সে শহরের কাঁচা বাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করল- এখানে অন্যান্য সবজির পাশাপাশি কচু ও কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে এবং লোকজন জড়ো হয়ে তা কিনছেন। আসমা বইয়ে পড়েছে, কচুতে অনেক পুষ্টিকর উপাদান আছে। তখন সে মনে মনে ভাবল তাদের গ্রামে ফিরে কচুর ব্যবসা শুরু করতে পারে। আসমা তার ভাইবোনদের নিয়ে তাদের পতিত জমি থেকে কচুশাক তুলে নিয়ে এসে পাশের পাইকারি সবজি বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার বাবাকে অনুরোধ করে। বাজারে গিয়ে আসমার বাবা সব শাক একজনের কাছেই বিক্রি করে চলে আসেন। যে পণ্যকে তারা কখনো গুরুত্ব দেয়নি, তার বাজার চাহিদা ও মূল্য দেখে অবাক হয়ে গেল তারা। আসমার আগ্রহে তার বাবা তাদের বাড়ির আশেপাশে আরও কচুর বাগান করলেন। ধীরে ধীরে কচুশাক, কচুর লতি, কচুর মুখির উৎপাদন করা শুরু করলেন এবং এই ব্যবসায় সফলতা পেলেন। কচুর বাগান করা খুবই সহজ এবং ব্যয় সাশ্রয়ী দেখে গ্রামের অনেকেই তাদের মতো বাহারি ধরনের কচুর বাগান করা শুরু করল। এখন তাদের গ্রামের অন্যতম ব্যবসা কচুর উৎপাদন। স্থানীয় পাইকারি বাজারে আসমাদের গ্রামের কচুর খুব চাহিদা। এখান থেকে রাজধানীর বড় বড় সুপারশপেও পাইকাররা তাদের কচু সরবরাহ করেন।
আসমার ব্যবসা আরও প্রসারের উপায়
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
কেস ৪: কুমুদের পাশের বাড়িটি রিক্তণ দিদির। তার একটি বিস্কুটের ফ্যাক্টরি আছে। সেদিন ঝুনুর জন্মদিনে তিনি এসেছিলেন তার ছোট মেয়েকে নিয়ে। গল্পচ্ছলে কুমু সেদিন তার ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার গল্প শুনে নিল। রিক্তার এসএসসি পরীক্ষার পর সে তার বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে শখের বশে একটা বেকারি কোর্সে ভর্তি হয়। বেকারি আইটেম শিখতে গিয়ে ননদ-ভাবি তাদের জমানো টাকা দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ওভেন কেনে। সেই থেকে রিক্তার ব্যবসায়ের আইডিয়ার শুরু। প্রথম দিকে পরীক্ষামূলকভাবে ময়দার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রুট গ্রেড ফ্লেভার (গন্ধ) এবং রং (কালার) আর আকৃতি (শেপ) দিয়ে বিস্কুট বানানো শুরু করে। শখের বশে একদিন পাড়ার দোকানে নিয়ে যায় বিক্রির জন্য। আকর্ষণীয় রং আর আকৃতির কারণে প্রথম দিনেই স্কুলের বাচ্চাদের নজর কাড়ে। পরদিন পাড়ার দোকানদার রিক্তাদের বাসায় এসে সেই বিস্কুটের অর্ডার দিয়ে যান। যাত্রাটা ছিল খুবই মজার। এরপর একদিন পাড়ার দোকান থেকে বিস্কুট চলে যায় সুপার শপে; এরপর দামি রেস্তোরাঁয়। এরপর রিক্তার ভাই-ভাবি যোগ দেন রিক্তার ব্যবসায়। একটা বেকারি খুলে দেন তারা। তারপর প্যাকেটজাত করা শুরু করে।
চিত্র ৪.৬: ফ্যাক্টরিতে বিস্কুট উৎপাদন করা হচ্ছে
প্যাকেটজাত হয়ে সারা দেশের নাশতার টেবিলে চলে যায় রিক্তার বিস্কুট। অবশেষে দেশ থেকে বিদেশেও। বেকারি থেকে হয় বিশাল ফ্যাক্টরি। রিক্তার ফ্যাক্টরির বিস্কুট এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রায় ৫টি দেশে রপ্তানি হয়।
রিক্তণর গল্পটা যতটা সরল, বাস্তব ততটা সহজ ছিল না। পাড়ার দোকান থেকে সুপার শপে নিতে তাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। অনেক প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে হয়েছে এবং ধৈর্য নিয়ে পুনরায় অভিনবভাবে উপস্থাপন করতে করতে একসময় সফল হয়েছে। রপ্তানির বিষয়টিতেও অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। গুনগত মান বজায় রেখে, নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে নমুনা (sample) প্রস্তুত করে বারবার পাঠাতে হয়েছে। রিক্তার বিস্কুটে সৃজনশীল ছাঁচের ব্যবহার, বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বাদ, নকশা ও আকৃতি এবং মানসম্মত ও আকর্ষণীয় প্যাকেটের কারণে রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে।
রিক্তার ব্যবসায় রপ্তানি বৃদ্ধি করতে আরও যা যা করা প্রয়োজন
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গল্পগুলো থেকে আমরা দেখলাম, কীভাবে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, স্থানীয় সম্পদ ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের ব্যবসায়িক আইডিয়াকে বাস্তবায়ন করছে। যে যে এলাকাতেই থাকি না কেন, কিছু না কিছু স্থানীয় সম্পদ থাকে, যা ব্যবহার করে আমরা একটা ব্যবসায়িক আইডিয়া পেতে পারি। আবার শহরের ক্ষেত্রে স্থানীয় সম্পদ সমানভাবে না থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের পণ্য বা সেবার চাহিদা বের করতে পারলে অন্যান্য এলাকা বা উৎস থেকে সেসব সংগ্রহ করে তার জোগান দেওয়া যেতে পারে।
তবে এটা মনে রাখা জরুরি, যেকোনো আইডিয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সততা, আগ্রহ, সঠিক দিকনির্দেশনা, মমত্ববোধ ও ধৈর্য নিয়ে টিকে থাকার মানসিকতা জরুরি। ভোক্তাকে ঠকিয়ে কিংবা মানহীন পণ্য দিয়ে অথবা অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে কখনো ব্যবসায় প্রসার ঘটানো সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, চাহিদা অনুযায়ী ও সময়মতো মানসম্মত পণ্য ন্যায্যমূল্যে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে সক্ষম হওয়াই ব্যবসায় সফল হওয়ার চাবিকাঠি। তবে সবাই প্রথমবারেই ব্যবসায়িক আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং সফল হবেন, তা কিন্তু নয়। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি আছে, সাফল্য-ব্যর্থতা আছে। সেখান থেকে কারণ খুঁজে বের করে নতুনভাবে আইডিয়া সাজাতে হবে। যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলার সাহস ও ধৈর্য থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাস ও বিচক্ষণতা দিয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনাকে সফল করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে।
তবে কোনো কিছু বাস্তবায়নের আগে দারুণ একটি আইডিয়া প্রয়োজন। তাই আমরা এবার আমাদের আশেপাশে স্থানীয় সম্পদ, বাজার বিশ্লেষণ করে এবং পরিবার ও সমাজের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে নিজেরা কিছু ব্যবসায়ের আইডিয়া তৈরি করব। নিজেরা দলে ভাগ হয়ে শ্রেণিকক্ষে স্থানীয় সম্পদ ও চাহিদার ওপর ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করব। একটি আইডিয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত সেটা বুঝতে হলে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। সেগুলো হলো
দলগত কাজ
ব্যবসায়ের আইডিয়া চূড়ান্তকরণ নিজ নিজ দলে আলোচনা করে নিজের আইডিয়ার যৌক্তিকতা বুঝতে বিবেচ্য দিকের ঘরগুলো পূরণ করো। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া যায়, তাহলে সেটির জন্য উদ্ভাবনী উত্তর খুঁজে নাও। নিজ দলে আলোচনার পর প্রতিটি দল অন্তত চারটি ব্যবসায়িক আইডিয়া তৈরি করো। দলগতভাবে সেগুলো উপস্থাপনের পর সবগুলো আইডিয়া থেকে শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে একটি আইডিয়া চূড়ান্ত করো। |
ব্যবসায়ের আইডিয়া উপস্থাপন
আমরা দলের সদস্যরা সবাই মিলে আমাদের ব্যবসায় আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করব। প্রয়োজনে আমাদের নিজ পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক বা যে কারো পরামর্শ নিয়ে চূড়ান্ত ব্যবসায়িক আইডিয়াটি সাজাব। ব্যবসায়িক আইডিয়াতে যেসব তথ্য থাকা আবশ্যক, তা তথ্যছক ৪.৪-এ পূরণ করে কাজটি সম্পন্ন করব। পরবর্তী ক্লাসে ব্যবসায়িক আইডিয়াটির পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন তৈরি করে উপস্থাপন করব। তবে চূড়ান্ত উপস্থাপনার জন্য আমরা ক্লাসে সবাই মিলে একটি 'আইডিয়া বিনিময়' সেমিনারের আয়োজন করতে পারি।
আইডিয়া বিনিময় সেমিনার
আধুনিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই 'বিজনেস আইডিয়া শেয়ার' বিষয়ক সেমিনার হয়ে থাকে। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যবসার আইডিয়া আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেন। উপস্থিত অতিথি ও দর্শকরা তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে আইডিয়াটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেন। উক্ত সেমিনারে হয়তো কোনো আইডিয়া আয়োজক প্রতিষ্ঠান নিজেদের জন্য নির্বাচন করেন অথবা কিনে নেন। আমরাও আমাদের আইডিয়াগুলো এ রকম একটি ডামি সেমিনারে উপস্থাপন করতে পারি। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রতিটি দল আমাদের ব্যবসার আইডিয়া আলাদা পোস্টারে প্রয়োজনীয় ছবি, রং ব্যবহার করে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব। সম্ভব হলে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনও করা যেতে পারে। একদলের উপস্থাপনের সময় অন্যদলের সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনব এবং উপস্থাপন শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য নির্ধারিত সময়ে কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা থাকলে প্রশ্ন করে জেনে নেব। এভাবেই প্রতিটি দল সেমিনারে অংশগ্রহণ করব। সেমিনার শেষে প্রতিটি চূড়ান্ত পোস্টার শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে টানানোর ব্যবস্থা করব।
সময়ের সঙ্গে অবশ্যই বাজারের চাহিদা বদলাতে থাকে। তখন সময় যা চায়, সেই অনুযায়ী ব্যবসায় আইডিয়ায় নতুন কিছু যুক্ত করতে হয় কিংবা পুরোনো পদ্ধতি বা সিস্টেম থেকে বের হয়ে অভিনব ও আকর্ষণীয় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এই কাজটি বেশ কঠিন। কঠিন এই কাজটিতে সফল হতে পারলে যেকোনো ব্যবসায় প্রসার প্রায় নিশ্চিত। এই সময়ের কিছু প্রচলিত ব্যবসায়ের আইডিয়া হলো ফ্যাশন হাউজ, ডেলিভারি কোম্পানি, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, অনুমোদিত (অ্যাফিলিয়েট) মার্কেটিং, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফটোগ্রাফি, হোমমেড ফুড, ফুচকা-চটপটি, চাইল্ড কেয়ার, হোমসার্ভিস প্রোভাইডার, গিফট শপ, শিশু ও মায়ের পণা, মেকআপ বা বিউটিফিকেশন, কফি শপ, টুরিস্ট সাপোর্ট, মোবাইল ফুড ট্র্যাক, পেট (pet) সার্ভিস, হোম ক্লিনিং সার্ভিস, অপটিক্যাল শপ, মুরগি পালন, অর্গানিক সবজি চাষ, অর্নামেন্টাল ফিশ, ওয়েডিং সাপোর্ট, এডুকেশন কাউন্সেলর, ফিজিক্যাল থেরাপি, মেন্টাল পিস ম্যানেজমেন্ট, গয়না তৈরি, ওয়েব ডিজাইন, হস্তশিল্প, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, কৃত্রিম ফুল তৈরি, মৌসুমী ফল বিক্রয়, পুরোনো জিনিস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি আরও কতো কী। আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, চারপাশে কী ঘটছে, তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে সব সময়। তাহলে আমরা হয়তো বিনা পুঁজিতে ব্যবসার আইডিয়াও খুঁজে পেতে পারি। পড়াশোনা কিংবা চাকরির পাশাপাশি করার মতো ব্যবসার আইডিয়াও হয়তো পেতে পারি। সততা, শ্রম, মেধা ও সৃজনশীলতার সম্মিলন ঘটিয়ে আমরা ব্যবসার আইডিয়া তৈরি করব, কারণ আমরা চাই 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী' প্রবাদটি আমাদের কাছে সত্যি হয়ে উঠুক। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি তাই চলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরণ থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হই-
যদি কোথাও কূল নাহি পাই তল পাব তো তবু।
ভিটার কোণে হতাশমনে রইব না আর কভু
যাবই আমি যাবই, ওগো, বানিজ্যেতে যাবই।
স্বমূল্যায়ন
ক) ব্যবসায় সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তোমার মাঝে কী কী গুণ রয়েছে বলে মনে করো?
খ) উক্ত গুণাবলির পরিচর্যার জন্য তোমার কী কী দক্ষতা অনুশীলন করা প্রয়োজন বলে মনে করছ?
গ) তোমার নির্বাচিত ব্যবসার আইডিয়াটির বাস্তবায়ন কীভাবে আমাদের দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারবে বলে ভাবছ?
ঘ) একটি যুগসই ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করার পর তা সফল বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে তুমি কী করবে?
Read more